Monday 24 May 2021

মানসিকতার একাল সেকাল

আমি অনেক দিন ব্লগ লিখিনা | প্রধান কারণ দুটি | এক, মনের সময়ের অভাব | দুই, লেখার মত বিষয়ের অভাব | 

মনের সময়ের অভাব মানে কি বলতে চাইলাম ? এর মানে এই যে সময় হয়তো আমি পেয়েইছিলাম, কিন্তু কিছু লেখার মত সময় জোগাড় করে উঠতে পারিনি | প্রথম করোনা ঢেউয়ের সময় অনেক দিন কলেজ বন্ধ ছিল, তখন তো সময় পেয়েছিলাম, কিন্তু লেখার মত মানসিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি | আমি যদি পেশাদার লেখক হোতাম তাহলে তো লিখতেই হত, কিন্তু যেহেতু নই, তাই আর লেখালেখি করা হয়নি |  তারপর যখন কলেজ শুরু হলো, একেবারে দ্রুতগতির দুরন্ত ট্রেনের মতো দৌড়ানো শুরু হলো | খুব কম সময়ের মধ্যে এক একটা সেমেস্টার শেষ করার নির্দেশ, ছাত্র ছাত্রীদের মতো আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলো | সরকারী ক্যালেন্ডারে কিছু ছুটি থাকলেও আমাদের সে ছুটি নেওয়ার উপায় ছিল না | শেষ পর্যন্ত আজ একটা ছুটি পেলাম আর হঠাৎ করেই মনে হলো কিছু লিখি |

দ্বিতীয় কারণ, করোনার আতঙ্কে আতঙ্কিত | কিন্তু আমি করোনা নিয়ে লিখতে চাইনি | করোনার কারণে দীর্ঘদিন কোথাও ঘুরতে যাইনি, তাই ট্রাভেল ব্লগ লেখারও কোনো উপায় ছিল না | 

আজকে আমার লেখার বিষয় বর্তমানের মহামারী পরিস্থিতির সাপেক্ষে একদমই অপ্রাসঙ্গিক, তবুও যেহেতু মনে হলো তাই লিখছি | করোনার কথা লিখব না যদিও বললাম, কিন্তু আমার লেখা শুরুই করছি সেই করোনা দিয়েই |

-------

করোনা আবহে আমি বাবাকে আর বাজার যেতে দিইনা | আমি যাই আর একসাথে অনেক কিছু কিনে আনি | সেই প্রসঙ্গে মা একদিন বললেন - দেখেছ, মেয়ে কি দ্রুত কি সুন্দর বাজার করে, কত কিছু আনে, তোমার তো ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যায় | তাতে বাবার উত্তর, আমি যখন চাকরি শুরু করেছি, তখন আমার মাইনে ৫০০ টাকা ছিল, তাই বাজারে গেলে আমাকে ভাবতে হত, সেই অভ্যাস কি এত সহজে যায়? আমি ভেবে দেখলাম, কথাটা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু তাই বলে আমিও যে বেহিসাবী তাও নয় | বর্তমানে কেউ বাজারে গেলে একদিনেই ৫০০ টাকা খরচ হয়ে যায় | তাই, খুব হিসাব করে বাজার করে যে খুব লাভ হবে, সেটা হয়তো আমি ভাবিনা | 

দ্বিতীয়ত, আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষদের সঞ্চয়ের মানসিকতা ছিল, তারা কৃচ্ছসাধন করেও সঞ্চয় করতেন | আমাদের সেই মানসিকতা নেই | আমরা মুহুর্তের জন্য বাঁচি | কারণ, আমরা বুঝি যে, আজ ভালো করে না খেয়ে, ভালো করে না বেঁচে, কোনো লাভ নেই | আমার আজকের সঞ্চয় আগামীকাল কাজে নাও আসতে পারে | 

আমরা যে সময়ের মধ্যে বেঁচে আছি, সেখানে আমরা দেশে দেশে অর্থনৈতিক পতন দেখেছি/দেখছি | খুব সাম্প্রতিক কালে আমরা গ্রীসের অর্থনৈতিক পতনের কথা জেনেছি, যা ২০১৪/২০১৫ সালে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল | মধ্যবিত্ত চোখের পলকে ভিখারী হয়েছিল | সেখানে একটা স্যান্ডউইচের জন্য একটা মেয়েকে রাতের পথে নামতে হয়েছে, সেই খবর আমরা সংবাদপত্র থেকেই পেয়েছিলাম | 

আবার, আমাদের নিজেদের দেশেই এক রাতের মধ্যে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট অচল হয়ে গেছে | নিজের ঘরে টাকা রেখে সঞ্চয় করেছিলেন যারা, তাদের দিনের পর দিন ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে| সেই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা মানুষকে সঞ্চয় বিমুখ করেছে | 

এদিকে আবার ব্যাঙ্কে টাকা জমাবো, তার উপায় নেই | চোখের সামনে পর পর সরকারী ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে | সেক্ষেত্রে ব্যাঙ্কে ১ কোটি জমানো থাকলেও যা, ৫ লক্ষ থাকলেও তাই | তার উপর আবার দিন দিন সুদ কমছে জমানো টাকার উপর | তাই আজ থেকে ১০ বছর আগে ফিক্সড ডিপোজিট করে টাকা যেভাবে বাড়তো, আজ তার অর্ধেকও বাড়ে না | 

আমি  পিএইচডি করার সময় আমার বরের থেকে ৪/৫ গুণ টাকা বেশী পেতাম, ইউকে তে পিএইচডি করার সুবাদে | কিন্তু আমি কিছুই জমাতে পারিনি | কারণ, ওখানে ব্যাঙ্কে টাকা রাখা আর ঘরের সিন্দুকে টাকা রাখা একই ব্যাপার | এক পেনিও সুদ নেই | ঠিক তেমনি ভাবেই আমার বাবার থেকে অনেক বেশি আয় করেও আমি চাইলেও কিছুই জমাতে পারব না | সামাজিক সুযোগ সুবিধাতে ভারত  ইউকের ধারে কাছে পৌঁছাতে না পারলেও, ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত নিয়মাবলীতে  ইউকে-কে টপকে যাবার চেষ্টা করছে | 

সঞ্চয়ে অনীহার আরো অনেক কারণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো - দিন দিন টাকার মূল্য কমছে | আমাদের আগের প্রজন্ম ১০ লক্ষ টাকা জমিয়ে বলতে পারত, আমার মেয়ের পড়াশুনো, বিয়ে নিয়ে আর চিন্তা নেই | ১০ লক্ষ টাকায় মেয়েকে M.Sc পর্যন্ত পড়িয়ে, ধূমধাম করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত, এমনকি নাতনির জন্য সোনার হার গড়িয়ে দেওয়া যেত |

কিন্তু আমি বা আমার প্রজন্মের কেউই এই রকম কথা বলতে পারিনা | করোনার কথা বলতে চাইনা, কিন্তু সে আসছেই | আমরা রোজ সংবাদপত্রে দেখছি করোনা চিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে | খুব সম্প্রতি একজন tollywood অভিনেতা এই বিষয়ে অনুযোগ জানিয়েছেন যে ওনার আত্মীয়র হাসপাতালে থেকে করোনা চিকিৎসা করিয়ে খরচ হয়েছে ১৮ লক্ষ টাকা | ভাবা যায়? তার সারাজীবনের সঞ্চয়  ১৮ দিনে শেষ | 

এই অস্থির সময়ে আমরা কোন ভরসায়  টাকা জমাবো ? আর কেনই বা কৃচ্ছসাধন করবো ? 

আমি যত টাকাই জমাই না কেন সেটা কমই হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মর জন্য | তাদেরকে নিজের পড়াশুনো জন্য student loan নিতে হবে | তারপর সারাজীবন চাকরী করে সেই loan শোধ করতে হবে |যেটা ইউকে, আমেরিকাতে হয়, আমাদের ভারতও সেই দিকেই এগোচ্ছে | 

এতো গেল, টাকা জমানোর তাগিদে আমাদের বাবামায়েদের  কৃচ্ছসাধন | এবার আসি পরিবারের চৌহদ্দিতে মায়েদের কৃচ্ছসাধনের গল্পে | বাবারাও নিশ্চয় করেন, আমি মেয়ে বলেই হয়তো মায়েদের কৃচ্ছসাধন বেশী নজরে পড়ে | 

মায়েরা কথায় কথায় উপোষ করেন, সবচেয়ে ছোট মাছটা খান, কেউবা খানই না | কিন্তু কেন? কারণ, জন্ম থেকেই তাদের মাথায় ঢুকে গেছে যে যত বেশী নিজেকে কষ্ট দিতে পারবে, সে স্ত্রী হিসাবে, মা হিসাবে তত সফল | হয়তো দেখা যাচ্ছে, তার নিজের স্বামী, বৌ-এর উপোষ করার পক্ষে না, ছেলেও চাইছে না, মা না খেয়ে থাকুন | কিন্তু তিনি সবার উপরোধ অনুরোধ উপেক্ষা করেই নিজের মতেই চলছেন | কারণ আজন্মলালিত মানসিক বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা ওনার নেই | 

আমার মা কখোনই অন্ধধার্মিক নন | উপোষ, বা ভাতের বদলে রুটি খাওয়ার ঘটনা আমাদের বাড়িতে খুবই সীমিত | মা যেহেতু ব্যাঙ্কে চাকরী করতেন, তিনি এই সারমর্মটি বুঝে গেছিলেন, খালি পেটে আর যায় হোক, হাজার হাজার গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা মেলানো যায় না | তাই, খাওয়ার ব্যাপারে কৃচ্ছসাধন না করলেও উনি যেটা করতেন, সেটা হলো অমানুষিক পরিশ্রম করা |

আমরা অফিস থেকে ফিরে বসি, উনি বসতেন না | শনিবার অর্ধেক ছুটি, তাই বাড়ি ফিরেই উনি বসে যেতেন কুলোয় করে চাল, ডাল ঝাড়াই বাছাই করতে | আমাদের বড় উঠোন ছিল/আছে | প্রতি শনিবার সেটা যে নিকাতেই হবে, এমন নিয়ম কোথাও না লেখা থাকলেও, আমার মা নিজের গড়া নিয়ম ভাঙতেন না | আর রোববারের কথা ছেড়েই দিলাম, কি কি করতেন তার তালিকা দীর্ঘ, শুধু এই টুকু বলি যে উনি কখোনই ৩-টের আগে স্নান করতেন না |  যে মহিলা রোজ ৯ টায় ভাত খেয়ে অফিস যেতেন, তার এমন অনিয়ম শরীরের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে সে তো জানা কথা | আর হয়েছেও  তাই |

আমার শশ্রুমাতা পুত্রসন্তানের জননী, তিনি অতীতে ভাবতেই পারেন, আমি না খেয়ে, বেশি বেশি কাজ করে শরীর ভেঙ্গে ফেললেও ক্ষতি নেই, ছেলে তো বৌমা আনবেই | কিন্তু আমার মায়ের ক্ষেত্রে তো সেই কারণ খাটে না | তাহলে কেন এত বেশি খেটে নিজের ক্ষতি করলেন?  

এটাও সেই মানসিক বন্ধন | আমার মা যখন চাকরী করতেন, আমাদের সীমান্তবর্তী সেই গ্রামে হাতে গোনা মহিলারা চাকরী করতেন, আর ব্যাঙ্কে চাকরীরত মহিলা একমাত্র আমার মা-ই ছিলেন | আমার মা আমাদের বড় করেছেন যে আধুনিক মানসিকতায়, সেই আধুনিকতা তিনি নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারেননি | আজ আনন্দবাজার পত্রিকাতে সন্তান মানুষ করা নিয়ে যে সমস্ত প্রতিবেদন দেয়, আমার মা ৩০ বছর আগে সেইভাবে আমাদের মানুষ করেছেন | আমার মা সময়ের থেকে অনেক এগিয়েই ছিলেন | এখন উনি পূর্ণ সময়ের লেখিকা | ওনার লেখা যারা পড়েন/পড়েছেন তারা এটা ইতিমধ্যেই  জানেন | 

কিন্তু উনি নিজে যখন চাকরী করতেন, তখন mainstream media (সিনেমা, গল্প) -তে চাকরী করা, উচ্চাকাক্ষী মহিলাদের villain হিসাবে দেখানো হতো | আজ অপরাজিত অপুতে অপু যে লড়াই করছে, আজ থেকে ৩০ বছর আগেই মা সেটা করে ফেলেছেন | কলকাতা শহরের কোনো ব্যাঙ্কে চাকরী করলে কি হতো জানিনা; কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে, অঙ্কে স্নাতোকোত্তর ব্যাঙ্ককর্মী মহিলাকে ঘিরে প্রচুর কৌতুহলী মানুষের আনাগোনা থাকলেও, মায়ের কোনো বন্ধু ছিল না | আমাকে আর আমার দিদিকে রোজ এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হত যে, আমার মা আজ কি রান্না করেছে? মনে হতো যেন, আমরা না খেয়ে বেঁচে আছি |  😆😆😆
এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে, একজন মহিলা কিভাবে বসে থাকবেন বা নিজেকে সময় দেবেন? নিজেকে সময় দেওয়া মানে বিলাসিতা | মা আর বিলাসিতা দুটি বিপরীতার্থক শব্দ | তাই, আমার মা নিজেকে নিংড়ে নিয়ে কাজ করতেন | অফিস করার জন্য যে সময়টা বাড়িতে দিতে পারতেন না, সেইটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন দেড় দিনে |

পরশু দিন Instagram-এ একটা post দেখলাম | একজন মহিলা নাকে oxygen concentration লাগিয়ে রুটি করছেন | রান্নাঘর দেখে তো বেশ সম্পন্ন বাড়ি বলেই মনে হলো | সেই ছবির উপরে লেখা - মা কা প্যার কা কোই তুলনা নেহি (something like that) | যিনি ছবিটা দিয়েছেন তিনি Caption-এ লিখেছেন, এটা কোথাকার ছবি জানিনা, কিন্তু যে ছবিটা তুলেছে, সে ছবি না তুলে রুটি করতে পারতো | আমি লেখকের সাথে সহমত | It is a kind of exploitation of human rights. এটা একধরনের দাসত্ব যাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে | এই দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসার মানসিক ক্ষমতা এখনো অনেক মায়েরাই জোগাড় করতে পারেননি | আমার মা পেরেছেন, প্রধানত তার শারীরিক অবস্থার জন্যই পেরেছেন |

আমি বা দিদি কিন্তু এমন নই | আমরা প্রয়োজন মত খাবারও খাই | কাজ করার দরকার হলে করি, কাজের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেও পিছপা হইনা | সেইজন্যই আমরা সঞ্চয় করতেও পারিনা | 😆😆😆😆 

ঘর ঝাঁট দেয়ার জন্য vacuum cleaner, মোছার জন্য mop সবই কিনে ফেলি | সবাইকে ভালো কাপে চা দিয়ে নিজেকে কষ্ট দিয়ে ভাঙ্গা কাপে চা আমরা মোটেই খাই না | আমি যেহেতু জামাকাপড় iron করি সেইজন্য আমার বরকে বলে আমার জন্মদিনের উপহার হিসাবে একটা iron স্ট্যান্ডও কিনিয়েছি | (বরের যদিও প্রবল আপত্তি ছিল, জন্মদিনে কোথায় আরাম করার জিনিস নেবো তা নয়, পরিশ্রম করার জিনিস নিচ্ছি) | মা সারাজীবন খাটের উপর জামাকাপড় রেখে কোমর বেঁকিয়ে iron করেছেন, কিন্তু একবারের জন্যও ভাবেননি একটা কাঠের বেঞ্চি করলে হয় | একজন ব্যাঙ্ককর্মী একটা কাঠের বেঞ্চি চাইলেই করাতে পারতেন | তার উপর, আমাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যেই কাঠের কাজ চলত, করালে করাই যেত কিন্তু কারো মনে হয়নি | আর এখন কোমরের সমস্যায় বেশিক্ষণ বসতেও পারেননা | 

অথচ যেটা করেছেন, সেটা হচ্ছে ভালো ভালো কাপ প্লেট showcase-এ তুলে রেখেছেন | কেন?  অতিথিদের জন্য | আমার দিদির বিয়ের কথাবার্তার জন্য যে কাপ প্লেটগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, দিদির বিয়ের পরে ১৪ বছরে সেগুলো ১৪ তো দূর, ৪ বার ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সন্দেহ | আমি খুব একটা না হলেও, আমার দিদি এই ব্যবস্থার সাংঘাতিক বিরুদ্ধে | আমি খুব বিরুদ্ধে নই, কারণ আমার মা সেই সব বাসন তুলে রাখলেও মোটেও খারাপ বাসনে খাওয়া দাওয়া করেন না | বরং বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর করে অনেক বাটি নিয়ে ভালো করে ভাত সাজিয়েই আমার মা খাবার খান | কিন্তু অনেক বাড়িতেই মায়েরা ভাঙ্গা কাপে চা খান, আর ভালো বাসন আলমারীতে তুলে রাখেন | কেন ? ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেবেন বলে? হয়তো তাই | যেমন, গয়না না পরে তুলে রাখতেন আমাদের সামনের বাড়ির কাকিমা | আমরা সারাজীবন শুনেই গেলাম উনি ১৫ ভরি গয়না পেয়েছিলেন বাপের বাড়ি থেকে | কিন্তু জীবনে গলার হার তো দূর, ওনার হাতের চুড়ি পর্যন্ত দেখিনি | 

আমাদের প্রজন্ম কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই কৃচ্ছ সাধন করবে? মনে হয় না | আর করার কোনো অর্থও নেই | 

১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে মানুষের মানসিকতা যেভাবে বদলাতো, আজ ৫ বছরেই তার থেকে বেশী হারে বদলাচ্ছে | ব্যক্তিগতভাবে, সাজ পোশাক, গয়নাগাটি নিয়ে আমি মোটেও ভাবিত নই, সেই বিষয়ে মন দিতেও আমি ইচ্ছুক নই | এই যুগে বিয়ে করেও আমি নিজের বিয়ের শাড়ি, গয়নাগাটি কোনো কিছুই আমি নিজে গিয়ে কিনিনি |
কিন্তু এখনকার দিনের বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ অপছন্দ প্রবল | মায়ের সারাজীবন তুলে রাখা গয়না মেয়ের পচ্ছন্দ নাও হতে পারে | আবার মায়ের পিতল কাঁসার বাসন মেয়ের কাজে নাও লাগতে পারে, কারণ মেয়ে ব্যবহার করে  dishwasher, microwave oven যেখানে এই ধাতুর পাত্র ব্যবহার যোগ্য নয় | দুনিয়া এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে মানুষের রুচি, চাহিদা মুহুর্তে মুহুর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে | 

সেই সময়ে দাড়িয়ে, আলমারীতে বাসন তুলে রেখে কি লাভ ?

তাহলে কি আমাদের বাবা মায়ের কৃচ্ছসাধন ভুল ছিল? আমার মতে, সঞ্চয়ের বিষয়ে কৃচ্ছসাধন মোটেই ভুল ছিল না, কারণ সেই সঞ্চয়ের ভবিষ্যত ছিল |
মায়েদের শারীরিক কৃচ্ছসাধন ভুল ছিল? সংক্ষিপ্ত উত্তর - হ্যাঁ | 

আর আমরা যে কৃচ্ছসাধন করিনা সেটা কি ভুল? 

সেটার উত্তর আমার জানা নেই | আমার পরবর্তী প্রজন্ম সেটার উত্তর দেবে | যেমন আমি আজ আমার পূর্ব প্রজন্মের কথা বললাম, সেই ভাবে তারাও একদিন আমাদের ভাবনাকে বিশ্লেষণ করবে |  সেই উত্তরের জন্য বরং অপেক্ষা করা যাক | 


 

 


Sunday 3 March 2019

Custom

When he comes,
he expects to be
treated like guest.

When she comes
he says, 'Please,
feel like your own'.


Saturday 10 March 2018

London Travel by Sourav

অনেকদিন পরে পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে মন আনন্দে ভরে ওঠে, আর তার উপর যদি প্রিয় বন্ধু হয় তাহলে আনন্দ আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়।
প্রায় ৫ বছর পর দেখা হলো আমার সাথে বাবুর, শেফিল্ডে। বাবু যে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে, সেখানে আমি একটা Talk দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সূত্রেই যাওয়া এবং দেখা হওয়া। স্টেশনে পৌঁছেই বাবুকে দেখে খুব আনন্দ হলো।
শেফিল্ড খুব শান্ত একটা শহর। সেখানে পৌছে মনটাও শান্ত হয়ে গেল। মনে হলো এইখানে বেশ কটা দিন চুপচাপ বসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু ইংল্যান্ড গেলাম আর লন্ডন দেখবো না তাই কি কখনো হয়। আর সেই জন্যই পরদিন সকালে আমরা ট্রেনে করে পৌছালাম St Pancras railway station -এ। কাছেই একটা হোস্টেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে আমাদের ব্যাগপত্র জমা করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লন্ডন ভ্রমণে। প্রথমেই গেলাম রানীর বাড়ী, Buckingham Palace-এ। আমরা খুব সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম বলে একদম ফাঁকাই ফাঁকাই ঘুরতে পারলাম, নইলে বাবু বলেছিলো, ওখানে প্রচন্ড ভীড় হয়, দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।




আমরা অনেক ঘুরে ছবি তুলে একটা টিউবে করে পৌছালাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে, Natural History Museum-এ। সেখানেও আগে পৌঁছে যাওয়ায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো, কিন্তু সকালের অল্প অল্প ঠান্ডায় লন্ডনের মাধুর্য আস্বাদন করতে ভালোই লাগছিলো, আর মিউজিয়ামের ভিতরে পৌঁছেও আরো অনেক মুগ্ধতা আমার মনকে ভরিয়ে তুললো। প্রথমে ঢুকেই দেখতে পেলাম, ডাইনোসরের জীবাশ্ম, যেটা পৃথিবীতে পাওয়া সম্পূর্ণ  জীবাশ্মগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জীবাশ্ম। তাছাড়াও  মিউজিয়ামের প্রতিটা তলাতেই নানারকমের বিষ্ময়, মানুষের বিবর্তন থেকে এই পলিমাটি-র উৎপত্তি, কি নেই সেখানে! আছে সুদৃশ্য সব পাথর, অজস্ত্র পাখি (taxidermied)। যা কিছু Natural, তার সব কিছুই আছে এই মিউজিয়ামে, এমনকি, নকল ভূমিকম্পও অনুভব করা যাবে এইখানে গেলে।




সেই সব দেখে অনুভব করে পৌছালাম The National Gallery তে। অনেক ভীড়, ভিতরে যাওয়া হলো না। কাজেই কিছু ছবি তুলে Trafalgar Square-এ চক্কর মেরে, lunch সেরে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌছালাম Big Ben-এর সামনে।



এতক্ষন লন্ডনে তেমন ভীড় দেখিনি, কিন্তু এইখানে পৌঁছে বেশ গড়িয়াহাটের মতো মনে হলো, সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়লো কদিন আগেই এইখানেই ঘটে গেছে সেই জঙ্গি হানা। মনটা ভারাক্রান্ত হলো, কিন্তু আবারো হাটতে থাকলাম সবার মতোই, স্রোতের তালে। পৌঁছাতে হবে, নদীর এপার থেকে ওপারে। কারণ পৌঁছাতে হবে London Eye-এর কাছে, আগে থেকেই যে টিকিট কাটা আছে।
সেখানে পৌঁছে দেখা গেলো বিশাল লাইন, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিলো বোধহয় আজ আর উঠতে পারলাম না। কিন্তু লাইন বেশ দ্রুতই এগোলো আর আমরাও London Eye-এর কোলে চেপে পড়লাম। একদম উঁচুতে উঠে পুরো শহরের দৃশ্য মনের মনিকোঠায় এবং অবশ্যই ক্যামেরায় বন্দি করলাম। আর হ্যা, একটা কথা, London Eye কিন্তু কখনোই থামেনা, ধীর গতিতে ঘুরতেই থাকে, ওর মধ্যেই উঠতে হয়, নামতে হয়।





সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা আসলাম Sea Life London Aquarium-এ। হাঙ্গর, পেঙ্গুইন, রংবেরঙের মাছ আর জলজ উদ্ভিদ দেখে যখন বাইরে আসলাম, তখনও দেখি আকাশ রঙিন, সোনালী সূর্যের আলোয়, অথচ প্রায় সাড়ে ৭ টা বাজে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্লান্তি কিছুটা দূর করে ফিরে আসলাম হোস্টেলে।




পরের দিন সকালে উঠেই প্রথমেই পৌছালাম Madame Tussauds London-এ। এখানেও অনেক সকালে পৌঁছেছিলাম বলে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল লাইনে, দরজাই খোলেনি। কিন্তু তাতে আফশোস নেই, কারণ তার কিছুক্ষণের মধ্যেই এতো ভীড় হয়ে গেলো যে আগে না পৌঁছালে কোনো ছবিই তুলতে পারতাম না।


মোমের মূর্তিদের সাথে বেশ কিছুক্ষন কাটিয়ে, লন্ডনের লাল বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম লর্ডসে। আমার সমনামী এইখানে জামা উড়িয়েছিলেন, ভেবেই মনে শিহরণ হলো। কিছু ছবিটবি তুলে সেইখান থেকে আবার বাসে করে পৌছালাম Baker Street-এ।



এইখানেই আছে Sherlock Holmes- এর মূর্তি আর museum, তার সামনেও প্রচুর লাইন।




আমাদের সময় বিশেষ ছিল না তাই আমরা চললাম পরের গন্তব্যে London Dungeon-এ।।
এটার বিশেষত্ব হলো অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীরা পুরোনো লন্ডনের infamous history গুলোকে অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেন। ঢোকার মুখে লেখা ছিল, দুর্বল চিত্তের লোকজন যেন না আসেন দেখতে। বাবুও বললো নেটে দেখেছে, এটা নাকি horror শোয়ের মতো, london eye -এর সাথে combined ticket পেয়েছিলো, তাই কেটেছিল টিকিট, নইলে আসতো না। কিন্তু আমার বেশ মজাই লেগেছে, কেউ ভয় দেখানোর আগেই খুব করে চেঁচিয়েছি যাতে ভয় না লাগে, অবশ্য তেমন ভয় লাগার মতো কিছুই ছিল না, শুধু রাস্তাগুলো ছিল অন্ধকার, আর সবাই পুরোনো দিনের পোশাক পড়েছিল বলে কেমন একটা লাগছিলো। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে পাশে একটু ঘুরে নিয়ে চললাম আমাদের শেষ গন্তব্যে। লন্ডনের বিখ্যাত Tower Bridge দেখতে।


মনটা একটু ভারাক্রান্ত হলো। আরো কিছুটা সময় কাটাতে পারলে ভালো হতো, অনেক কিছুই যেমন দেখা হলো, তেমনি অনেক কিছুই বাদও রইলো। কিন্তু হাতে সময় যে খুবই কম, আমায় আবার ফিরতে হবে। কাজেই দেড় দিনের সফরের স্মৃতি মনে ভরে উঠে পড়লাম ফিরতি বাসে।

Thursday 11 May 2017

নিউইয়র্কের পথে পথে: পর্ব দুই

কদিন আগে একটা পোস্ট করেছিলাম, তাইতে আমার নিজের কোনো ছবি ছিল না। তারপর কেউ কেউ আরো বিস্তারিতভাবে জানতে চেয়েছেন নিউইয়র্ক সম্পর্কে। অগত্যা আবার একটি পোস্ট। তবে দ্বিতীয় অনুরোধের উত্তর হয়তো আমি দিতে পারবো না তেমন করে, কারণ তিন দিনে শহরের অন্তরকথা আমি পড়ে উঠতে পারিনি। আমার বান্ধবী আমার অনেক ছবি তুলেছিলেন, তিনিও ইতিমধ্যে আমায় নিউইয়র্কে তোলা সব ছবিগুলো ইমেইল করেছেন, তাই প্রথম আবদারটা মেটাতেই পারি। সাথে প্রভিডেন্সে আমার নিজের তোলা সেলফি সেটাও যুক্ত করে দিচ্ছি।

আগেরদিনই বলেছি প্রভিডেন্স খুব শান্ত শহর, তেমনি দোকানপাটও বেশ কম। আমি যে জায়গাতে ছিলাম তার আশেপাশে সাধারণ স্যালাড স্যান্ডউইচ পাওয়াটাই মুশকিল ছিল। খাবারের দোকান ছিল, পাশের শপিংমলের ফুডকোর্টও ছিল কিন্তু সবই বেশ তেলযুক্ত খাবার। আমার রূমমেট (কনফারেন্সের সময়ের), বেশ করিৎকর্মা, তিনি একটা দোকান খুঁজে পেয়েছিলেন যাতে একটা পুঁচকে সেকশন ছিল স্যালাড  স্যান্ডউইচের, অথচ পিজ্জা বা বার্গার সেকশন অনেক বড়। সেই সব দেখে আমার মনে হয়েছে, ইউ.এস এর লোকজন বুঝি খুব junkfood খেতে ভালোবাসে। নিউইয়র্কেও junkfood/street food-এর মেলা। রাস্তার ধারেই হালাল কার্ট, খুব সস্তায় খাবার পাওয়া যায়, ৫$ দিলে পেট ভরে খাওয়া হয়ে যাবে।  স্বাস্থ্যকর খাবারও পাওয়া যাবে, শুধু একটু খুঁজতে হবে। তবে কোনো রেস্তোরাঁতে গেলে সেই খরচটা তিন থেকে চারগুন হয়ে যাবে। তার উপর ট্যাক্স এবং টিপস। এর সাথে ইউ.কে তে আমাদের তেমন পরিচয় নেই। এখানেও ট্যাক্স কাটে কিন্তু সেটা দামের মধ্যেই ধরা থাকে তাই আলাদা করে চোখে পরে না। আর এখানে টিপস দেওয়ার কোনো চল নেই। কিন্তু ইউ.এস-এ গেলে টিপস দেওয়াটা সৌজন্যমূলকের পর্যায় পেরিয়ে প্রায় বাধ্যতামূলক।

আর সেই কারণেই কিনা জানিনা, দোকানদারেরা খরিদ্দারের সাথে অত্যন্ত মধুর ব্যবহার করে। আমাদের দেশে তো অপরিচিতকে hi hello বলার চল নেই, আবার জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে thank you বলা আমাদের পোষায় না। ব্যাপারতা অনেকটা এইরকম: আরে বাবা, আমাদেরকে জিনিস বেচেই তো ওদের দিন চলে, খামোখা thank you কেন বলতে যাবো?
কাজেই এই hi, hello, thank you, see you সব এখানে (ইউ.কে) থেকেই শেখা। ইউ.এস-এ দেখলাম, এই ব্যাপারটা আরো ব্যাপক ভাবে প্রচলিত। দোকানে ঢুকলেই, hi, how are you, do you need any help? আর যদি আপনি কিছু না কিনেও বেরিয়ে যান, তাতেও বলবে, have a great day. আমার বান্ধবী তো ওখানেই থাকেন, তিনি তো ভালোমতো গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন সবার সাথেই। ওটাই স্বাভাবিক ওখানে। আমি অবশ্য ইউ.কের নিয়মেই চলেছি, শুধু thank you বলেই এক হপ্তা কাটিয়ে দিয়েছি।

অবশ্য ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকার একটা শাখায় গিয়ে thank you-এর চেয়ে একটু বেশীই বলা উচিত ছিল। আমি svc conference থেকে পাওয়া একটা চেক ভাঙাতে গেছিলাম। ছোট্ট branch তাই বেশী কর্মচারী ছিলেননা। কিন্তু সবাই মিলে এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। আমার যেহেতু ওখানে কোনো bank account নেই এবং আমি ওখানকার বাসিন্দা নই, তাই তাদের বোধহয় অনেককিছু যাচাই করতে হচ্ছিলো, অনেকক্ষন আমাকে সেই জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তবে আমার ভালো লেগেছে যে ওনারা একবারও বলেননি, না হবে না, আজ চলে যান। আমি দেখতে পারছিলাম, ওনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন আবার ফোনেও কথা বলছেন আমার ব্যাপারে। শেষে আবার মাফও চাইলেন, আমাকে এতোক্ষন অপেক্ষা করানোর জন্য।



এই সেই ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকার সুউচ্চ টাওয়ার। ভালো করে ছবি তুলতে পারিনি, ছবি তুলতে গিয়ে ঘাড় ব্যাথা করছিলো। অবশ্য আমি এইখানে যাইনি। গেছিলাম অন্য শাখায়। 

অনেকক্ষন ধরে ব্যাঙ্কে দাঁড়িয়ে থেকে পরিশ্রান্ত হওয়ার পর, সেদিন রাতে পেট পুরে খুব স্বাদু খাবার খেয়েছি, আমাদের গৃহকর্ত্রী নিয়ে গেছিলেন সেখানে। তা বাদেও নিউইয়র্কে প্রতিদিনই ভালো ভালো জায়গায় খেয়েছি। বান্ধবীর খুব শখ ছিল আমাকে দিয়ে সব ভালো ভালো খাবার টেস্ট করাবেন। কাজেই তার সাথে seafood থেকে শুরু করে আমাদের বাংলার পাবদামাছ আর ছোট মাছের ঝাল অনেক কিছুই খেয়েছি (আগের পোস্টে ছবিও দেওয়া আছে), খেয়েছি থাই দেশের রাজকীয় খাবার, বেগুনি রঙের ফুলের মতো ডাম্পলিংস (যাকে আমরা মোমো বলেই বেশি জানি)। আমার বান্ধবী yelp তে রিভিউ দেন। লিংকগুলো পেলে আমি তার অনুমতি সাপেক্ষে এই পোস্টের শেষে জুড়ে দেব। (check at the end)


Purple blossom dumpling

যেখানে মাছ খেতে গেছিলাম (জ্যাকসন হাইটস), সেখানে গিয়ে বাংলায় কথা বলেই খাবার অর্ডার করেছি, ওখানে চলে গেলে হটাৎ করে আপনার মনে হবে, আপনি হয়তো ঢাকায় চলে এসেছেন, সবার সাথে বেশ আড্ডাও মেরেছি। আর একটা কাজ করে আমি আর আমার বান্ধবী দুজনেই খুব গর্বিত, সেটা হলো কাঁটাচামচ দিয়ে মাছ ছাড়িয়ে খেয়েছি, বিশ্বাস করুন খাবার শেষে কাঁটার গায়ে মাছ লেগে ছিল না। জ্যাকসন হাইটসের বাংলা বাজারে দোকানপাটের নামও বাংলায় লেখা, সে ছবিও আগের পোস্টে আছে। 

আগের পোস্টে রুজভেল্ট আইল্যান্ডের farmers' market-এর ছবিও দিয়েছিলাম। ছোট্ট দ্বীপের মধ্যে ছোট্ট বাজার, সেখানে সতেজ সব্জিপাতি দেখে বেশ আনন্দ হয়েছিল। ওইখানের grocery store যাকে আমরা সাদা বাংলায় বলতাম মুদির দোকান, সেখানেও প্রচুর সব্জিপাতি, চীজ দেখতে পেয়েছিলাম। অথচ প্রভিডেন্সের সেই একমাত্র grocery store (যেটা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম) তাতে সবই তৈরী খাবার, এমনকি গোটা ফল পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু রুজভেল্ট আইল্যান্ডে এসে দেখলাম, সবই পাওয়া যাচ্ছে, স্যালাড স্যান্ডউইচ-ও বেশ ভালোই পরিমানে আছে, ইউ.কের যেকোনো grocery store-এর মতোই। তাই প্রথমে যা ভেবেছিলাম, যে ইউ.এসের লোকেরা শুধুই বুঝি readymade অথবা junkfood খায়, সেটা সত্যি নয়। কেউ কেউ বানিয়েও খায় আর খাওয়ায়। 😉

আমরা যার বাড়িতে ছিলাম, তিনি খুব সুন্দর স্বাস্থ্যকর খাবার রান্না করে খাইয়েছিলেন, ওই farmers' market থেকে সবজি কিনেই বানানো।


গৃহকর্ত্রীর তৈরী করা খাবার 


গৃহকর্ত্রীর সাথে আমরা 

আমার বান্ধবী আর আমি দুজনেই এই home restaurant-কে zomato/yelp-তে পাঁচে পাঁচ রেটিং দেয়ার জন্য রাজি। 

খাবার নিয়ে অনেক কথা হলো, অবশ্য মানুষ থাকলেই খাবার থাকবে, তবুও একটু ঘোরাঘুরির কথাও বলি।
কি কি দেখেছি তার কিছুটা আভাস আগের পোস্টেও দিয়েছি। এখানে একটু বিস্তারিত দিই। প্রথমদিন নিউইয়র্কে পৌঁছেই মধ্যরাতে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের মাথায় চড়েছিলাম। না না লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নয়, কিংকং ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে ওই ১০১ তলা বাড়ির মাথায় ওঠা দুস্কর। রীতিমতো টিকিট কেটে লিফটে করেই উঠেছি, তবে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, এইটা কোনো ছুটির মরসুম নয়, কাজেই কোনো লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। 


এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর ৮৬তলা থেকে শহর


এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর মাথায় মধ্যরাতে ঘুমন্ত আমি 


প্রচন্ড হাওয়ায় কেঁপে যাওয়া আমার হাতে তোলা বান্ধবীর ছবি 

তবে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল Museum of Modern Art দেখতে গিয়ে। কি বিশাল লাইন কি বিশাল, টিকেটের লাইন, ভিতরে ঢোকার লাইন, উফফ। ভিতরে এতো ভীড়, মনে হচ্ছিলো পালিয়ে যায়, পুরো গড়িয়াহাট। কিন্তু Museum of Modern Art-তে তো সবসময় ঢুকতে পারবো না, অগত্যা দুই ঘন্টা মতো ওখানেই কাটিয়েছি। সত্যি বলছি শিল্পীদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিলো। আমি নিজে modern art কিছু বুঝিনা এটা সত্যি কিন্তু একটু সুযোগ পেলে হয়তো মন দিয়ে দেখতাম।

লোকজন এতো দৌড়াচ্ছে যে কোথাও এক দন্ড দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ নেই। কেউ বেশিক্ষন কোথাও দাঁড়াচ্ছে না বটে তবে ওতো ভিড়ের মধ্যেও কিন্তু একটা নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। না দাঁড়ানোটাই শৃঙ্খলা। যেমন ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা 'দা স্টারি নাইট, The Starry Night-এর সামনে সবসময় একটা জটলা, কিন্তু তাতে নতুন লোক ঢোকা আর পুরোনো লোক বেরিয়ে যাওয়াটা সমানুপাতে চলছে, কাজেই একবার দেখলে মনে হবে, ইসস, ভীড়টা সরছে না কেন ? চিন্তা নেই টুক করে দাঁড়িয়ে পড়ুন, দেখবেন ঠিক সামনে পৌঁছে গেছেন, ছবি তোলার সুযোগও পেয়েছেন। কিন্তু ওইটুকুই, পড়া বা বোঝার সময় নেই। এই প্রসঙ্গে আমার বান্ধবী একটি ভালো কথা বলেছেন, 'আর্টের লোকেদের যদি ফিজিক্সের কঠিন কঠিন সমীকরণ ধরিয়ে দেয়া হয়, তারা কি বুঝবে ? তাই বলে কি আইনস্টাইনের নাম তারা জানবে না বা তার সম্পর্কে জানবে না।'
কাজেই দুঃখ করে লাভ নেই, যেটুকু দেখা গেছে, সেইটাই সঞ্চয়। দেখলাম না বুঝলাম না বলে মন খারাপ করে লাভ নেই, আর না বুঝলেই অপমান করলাম শিল্পীর শিল্পসত্বাকে এমন ভাবার ও কারণ নেই।



মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট, নিউইয়র্ক 

ভীড়ের মধ্যে সবাইকে সুযোগ করে দেওয়ার আর একটা নমুনা দেখলাম wall street-এ ষাঁড়ের সামনে।আমার বান্ধবী আমার ছবি বেশ ভালোই তুলেছেন কিন্তু আমি তার ছবি তুলতে গিয়ে ভুল করে ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অগত্যা মোবাইলেই তুলতে হলো, তিনি এসে যে আমায় দেখিয়ে যাবেন  সে সুযোগ তো নেই। কয়েক মুহূর্ত সময় পাওয়া গেছে, অন্য সবাইকেও তো জায়গা করে দিতে হবে। কাজেই আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে সময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। এই কারণেই বলে, কিছু কাজ সময়ে না করলে পরে আর সুযোগ হয়না। এই জ্ঞানের বাণীটা মনে পড়ে গেলো।



ওয়াল স্ট্রিটে ষাঁড়ের সঙ্গে 

তবে নিউইয়র্কের লোকজন খুব বেশি জ্ঞান শোনে বলে মনে হয়না। মূল শহর ম্যানহাটানে কেউ ট্রাফিক নিয়ম মানে না। গাড়িও চলছে, মানুষও চলছে। আমি নিয়ম মেনে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে দেখি আমজনতা পথের ও প্রান্তে চলে গেছে ট্রফিক লাইট সবুজ হওয়ার আগেই। গাড়িও বা কতক্ষন এই অনিয়ম সহ্য করবে, কাজেই তারাও চলতে শুরু করছে সঠিক সিগন্যাল হওয়ার আগেই। তবে সবারই গতি কম থাকায় আমার চোখের সামনে কোনো অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখিনি, তবে শুনলাম নিউইয়র্কে শহরে অনেক এক্সিডেন্ট হয়। গাড়িঘোড়া আর লোকজনের চলাচলের যে নমুনা দেখলাম তাইতে এক্সিডেন্ট হওয়ার খবরে আশ্চর্যের কিছু নেই।



টাইমস স্কয়ারে ভীড়ের মাঝে 

এই গাড়িঘোড়ার কথায় মনে পড়লো সেন্ট্রাল পার্কের মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি চলে, ঠিক যেমন চলে কলকাতার ভিক্টরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে, অবশ্য আমি ওখানেও চড়িনি, এখানেও না। আবার দেখলাম রিক্সাও চলছে। সেন্ট্রাল পার্ক এতো বড় যে ঘোড়ার গাড়ী বা রিক্সাটা বেশ কাজের, আর তাই ভাড়াটাও বেশ 😛।


সেন্ট্রাল পার্কে

রিক্সার সাপেক্ষে ফেরীর ভাড়া কম। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে যাওয়ার জন্য ফেরী নিতে হয়েছিল, আলাদা করে ফেরী ভাড়া করে নয়, টিকেটের মধ্যেই ধরা, তবুও যদি অন্য জায়গার টিকেটের দামের সাথে তুলনা করি, তাহলে বেশ সঙ্গতই, তবে এটাও ঠিক স্ট্যাচু দেখা বাদে আর কিছু করারও নেই। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে যাওয়ার সময় ফেরীতে safety announcement করে, সবাই বসে থাকুন, তবে কেউ শোনে না, আমরাও শুনিনি, বসে থাকলে তো ছবি তোলা যায়না, সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে বলে  কিছু দেখাও যায়না, অগত্যা 😕😑।


ফেরী থেকে শহরের ছবি তোলার হুড়োহুড়ি 


ফেরীতে আমরা 

আমাদের দুজনের একসাথে ছবি খুব কম আছে, কারণ আমরা একে ওপরের ছবি তুলে দিচ্ছিলাম। তবে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি-তে গিয়ে একজন সদয় হয়ে আমাদের ছবি তুলেদিয়েছিলেন ক্যামেরাতে, পরে দেখলাম ভালোই ছবি তুলেছেন সেই অপরিচিত ভদ্রলোক।






স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, লিবার্টি আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক

একদিন গেছিলাম নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার দেখতে। এখন একটাই গগনচুম্বী অট্টালিকা তাই হয়তো নাম ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। পুরোনো দুটো বিল্ডিংয়ের জায়গায় বিশাল জলাশয় বা ঝর্ণা যেখানে সব সময় জল গড়িয়ে পড়ছে। সেটা কি অশ্রুকে ইঙ্গিত করছে? 



এই ছবিতে কিন্তু আমি আছি 


আর এতে আমার বান্ধবী 

নিউইয়র্কের গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো মাঝে মাঝে মেঘে ঢেকে যায়, সেটা দেখে অদ্ভুত একটা ভাবনা এসেছিলো মাথায়। প্রকৃতিকে সরিয়ে এই ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল তৈরী করেছি আমরা আর প্রকৃতি সুযোগ পেলেই মায়ায় মুড়ে দিচ্ছে সেই জঙ্গলকেই। 


মেঘে ঢাকা শততলা 

তবে প্রকৃতি খামখেয়ালি। আমি যেদিন পৌছালাম আমেরিকা, সেদিন প্রচন্ড গরম, ৩১ ডিগ্রী সেন্ট্রিগেড ছিল প্রভিডেন্সে, আর একদিন নিউইয়র্কে প্রচন্ড বৃষ্টি হলো, সেইদিন তাপমাত্রা নেমে গেলো ১০-এ। আমেরিকাতে অবশ্য ফারেনহাইট-এই তাপমাত্রার কথাবার্তা চলে, কাজেই বারবার আমাকে গুগল বাবাজির স্বরণাপন্ন হতে হচ্ছিলো। তারপর আর এক জায়গাতেও আমি বেশ ভুলভাল কথা বলে বলেছি, খাবারের ওজন এরা পাউন্ডে মাপে, সেটা আমার খেয়াল ছিল না, আমি হটাৎ করে ভাবি হটাৎ করে ডলার থেকে পাউন্ড নিয়ে কেন কথা হচ্ছে, আমি বলেও দিয়েছিলাম, পাউন্ড না, পাউন্ড না ডলার হবে 😅।

কিছু ছবি দিয়ে গল্প শেষ করি। কারন এর থেকে বেশী বিস্তারিতভাবে আমি জানিনা নিউইয়র্ক সম্পর্কে।
কি আর করিব ? বরং আমার বান্ধবীকে বলিব, লিখিতে, তিনি যদি কখনো লেখেন তাহা হইলে আমি শেয়ার করিব।



আমার রুমমেট, কনফারেন্স চলাকালীন 

ও হ্যা, আরো একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমি বাড়ি ফিরতেই আমার ইউ.একের হাউসমেট এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলেন, তিনি ভালোবেসে আমার জন্য ডাল ভাত রেঁধে রেখেছিলেন, ৩ বছর একসাথে থেকে তিনি জেনে গেছেন, বর্ণালী কিছুই খেয়ে হজম করতে পারেনা। বাড়ি ফিরে বাড়ির রান্না খেয়ে মনটা ভরে গেলো। একটা ধন্যবাদ যথেষ্ট নয় এই আনন্দ প্রকাশ করার জন্য। (And yes, in this context I would like to talk about my housemate and her kindness. She knew that my stomach would be upset so she made simple rice, lentis, boiled potato mash, brinjal fry and paneer for me. That homemade food gave me immense joy and comforted my stomach as well as my heart. A single 'thank you' is not enough to express my gratitude 😊). (অনুবাদটা তার জন্য)


হাউসমেটের তৈরী ঘর কা খানা 

মন আমার অবশ্য ম্যানচেস্টারের সবুজ উপত্যকা দেখেও ভরেছে। ভারত থেকে এদেশে আসার সময় সবসময়ই খুব মন খারাপ থাকে। এই প্রথমবার ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে নেমে এতো আনন্দ হলো কি বলবো। এটা এখন দ্বিতীয় বাড়ি বলেই হয়তো। আর শেফিল্ড স্টেশনে পৌঁছে যখন নিজের ইউনিভার্সিটি-র চূড়া দেখতে পেলাম, উফফ কি খুশিই না হলাম। Kash, ye khushi roj subha 9 baje hoti 😥।তাহলে এতদিনে পিএইচডি শেষ করে ফেলতাম।





Conference swag

Link to the restaurant review: https://www.yelp.com/user_details_reviews_self?userid=ys2r72zSLb2wqUcXLvN-lw

Name:
Tina’s Restaurant
The Nuaa
Guy’s American Kitchen and Bar

মানসিকতার একাল সেকাল

আমি অনেক দিন ব্লগ লিখিনা | প্রধান কারণ দুটি | এক, মনের সময়ের অভাব | দুই, লেখার মত বিষয়ের অভাব |  মনের সময়ের অভাব মানে কি বলতে চাইলাম ? এর মা...